লিলি কাদের
তৎকালীন সময়ে তথা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য পুরুষ রাজাকারের রেকর্ড মিললে ও নারী রাজাকারের তথ্য খুঁজে পাওয়া ততটা সহজ ছিল না। কেননা ঐসব নারী রাজাকাররা বেশিরভাগই ছিলেন ধনী পরিবারের তথা সম্ভ্রান্ত এবং ক্ষমতাধর পরিবারের ছিলেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ কারাগার পরিদর্শনে গেলে ৫০ জন নারী রাজাকারের সন্ধান পান। যাদেরকে ৯ হাজার ৪৯৩ জন যুদ্ধাপরাধীদের সাথে দালাল আইনে আটক করা হয়েছিল।
(সূত্র: পূর্বদেশ ২৩ মার্চ ১৯৭২ সাল)যারা ছিলেন পাকিস্তানীদের সহচর।যেহেতু এসব নারী রাজাকাররা সম্ভ্রান্ত পরিবারে ছিলেন এ কারণে তারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে পরবর্তীতে
এসব রেকর্ড মুছে ফেলতে সক্ষম হন।
এছাড়া সারাদেশে নারী রাজাকার হিসেবে যে লিস্ট করেছিলেন সেখানে ৬২ জন নারীর কথা উল্লেখ আছে। মূলত এসব নারীরা ছিল বেশিরভাগই ইয়াহিয়াসহ পাকিস্তানি আর্মির কর্মকর্তাদের কেস্ট। সরাসরি বলতে গেলে শয্যাসঙ্গিনী। বোঝা যায় তারা পাকিস্তানের গণহত্যা সমর্থন করতেন ।মূলত নিজেদের স্বামীদের উন্নতিসহ সুযোগ সুবিধা পাবার জন্য তারা পাকিস্তানি অফিসারদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতেন ।এবং দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন।
“আরো ৩৯ জন দালাল গ্রেফতার।”
(সূত্র: জানুয়ারি, রবিবার, ১৭ পৌষ ১৪৭৮)
৩৯জনের নাম প্রকাশ করা হয় ।এর মধ্যে দুইজন নারী রাজাকার ছিলেন এদেরকে
গ্রেফতার করা হয় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ।
নামগুলো হলো, ২৫ নম্বর নামটি বেগম রোকিয়া আব্বাস, ঢাকা।
২৯ নম্বর ফরিদা বেগম শিবচর, ফরিদপুর।
তৎকালীন বেশ নাম -ডাকওয়ালা ওষুধ কোম্পানি করিম ড্রাগস- এর মালিকের স্ত্রী এ তালিকায় ছিলেন। পরবর্তীতে মেজর জিয়া আইন বাতিল করার সুযোগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ।এছাড়াও আফরোজ নুর আলী নামে এক নারী রাজাকারের নাম পাওয়া যায় ।যিনি তৎকালীন এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী ছিলেন। সেখানে আরও একজনের নাম পাওয়া যায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কন্যা রাইসা বেগম। যিনি তৎকালীন পাকিস্তানের জমিলাতুল সিলমের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ।তিনি ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তার বিবৃতিতে লিখেছেন, “২৬শে মার্চ ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির দিন।” এবং
তিনি বিভিন্ন আপত্তিকর বাক্য টেনে বলেন “আল্লাহু আকবর” এর স্থলে শেখ মুজিব পৌত্তলিকদের যুদ্ধের স্লোগানে “জয়বাংলা” আমদানি করেছিলেন।
(সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম ১৯৭১:২৯ চৈত্র ১৩৭৮)
এ মহিলা ধর্মকে ঢাল বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী আর শেখ মুজিবুর রহমানকে ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি হুমকি দিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করলে, পাকিস্তান এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে।
ঢাকা, ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ সেক্টর ২- এর অধীনস্থ সিদ্দিক বাজার, গেরিলা ইউনিটের দুর্ধর্ষ সেনানীরা কুখ্যাত জরিনাকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেফতারের পর জরিনা স্বীকার করেন যে কার সহায়তায় পাকবাহিনী বহু মেয়েকে ধরে নিয়ে যান ।
দৈনিক পূর্বদেশে – এ প্রচারিত রিপোর্ট অনুযায়ী ৫ডিসেম্বর ১৯৭১-এ খুলনা বিভাগে মহিলা প্রতিরোধ কমিটি নামে পাকিস্তান সমর্থক মহিলাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বক্তারা যেকোনো মূল্যে পাকিস্তান রক্ষার প্রতিজ্ঞা করেন।
১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাক প্রতিনিধি দলের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে ২জন নারী সদস্যের নাম পাওয়া যায়। সেখানে একজন ছিলেন বিএনপি- এর এবং সাবেক মন্ত্রী রাজিয়া ফয়েজ। তিনি ছিলেন হাজার ১৯৭৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচনে মুসলিম লীগ (খান-এ-সবুর )থেকে প্রথম নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদের সময়ে তিনি সাতক্ষীরা সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।এবং শিশু ও মহিলা এবং সমাজ কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী হয়েছিলেন। অন্যজন ছিলেন ড.
ফাতিমা সাদিক।
সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান ১৯৭১ সালের ১২ ই জুন,রেডিও পাকিস্তানে বক্তব্য রাখেন, জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের মধ্যে পাকিস্তানে আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা স্থাপনের কাজ করার আহ্বান জানান। আক্তার সোলায়মান তার ভাষণে টিক্কা খান এই দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সঠিক ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।( সূত্র: দৈনিক আজাদ,১৩ জুন)
বেগম আখতার সোলায়মান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্টই বিরোধিতা করেছিলেন ।সৌদি বাদশা খালেদ খন্দকার মোশতাকের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন,” আমার প্রিয় ভাই নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় আপনাকে আমি নিজের ও সৌদি জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
বাংলাদেশের আগস্ট -এর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাসীন।১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে বেগম আখতার সোলায়মান ভুট্টোকে এক চিঠিতে লেখেন,” আমি সব সময় আপনাকে একজন অসীম সাহসী, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও ব্যতিক্রমী দূরদর্শী মানুষ হিসেবেই জানি। বাংলাদেশ বিষয়ে আপনি সকল প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে গেছেন। আপনি মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন দেখিয়ে অত্যন্ত উদারতার পরিচয় দিয়েছেন ।”( সূত্র: এ এল খতিবের হু কিল্ড মুজিব)
রোকিয়া কবির এবং মুজিব মেহদী “মুক্তিযুদ্ধ ও নারী” এই বইটিতে লিখেছেন,”নারীরা সর্বত্রই সক্রিয় ছিলেন যেমন সক্রিয় ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকায়।” যারা এরকম ভূমিকায় লিপ্ত ছিলেন তাদের অবশ্য অধিকাংশই পারিবারিক স্বীকৃতি ছিল।
লক্ষণীয় যে, এরকম প্রায় সক্রিয়দের পিতা বা চাচা স্বামী বা ভাই কিংবা পুরো পরিবারই শান্তি বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন।যেমন পাকসেনা বা রাজাকারদের ক্যাম্পাসসমূহে কর্মরত আয়ারা।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে দৈনিক পূর্বদেশ- এ একটি সংবাদে প্রচারিত হয় শিরোনাম ছিল,”সহস্রাধিক মেয়ে রাজাকার হয়েছে”
সেখানে বলা হয়েছে।
” এক হাজারেরও বেশি যুবতী মেয়ে আপওয়ার রাজাকার হিসেবে নাম রেজিস্ট্রি করেছে বলে আপওয়ার সহকারি সভানেত্রী বেগম প্যাটেল জানিয়েছেন। তিনি বলেন,”মেয়ে রাজাকারদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করা হয়েছে।তার মধ্যে রয়েছে দান সংগ্রহ,কাপড় সেলাই দানের জিনিসপত্র প্যাক করা এবং বেসামরিক জনতার ওপর ভারতীয় বিমান আক্রমণের
ফলে আহতদের চিকিৎসা করা ।
বেগম প্যাটেল বলেন, “পাকিস্তানি বীরযোদ্ধাদের ব্যবহারের জন্য পাঁচশত পার্সেল সমাজ কল্যাণ দপ্তরে ও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবেন।”
তাছাড়াও বরিশালে ৬ নারী রাজাকারের সন্ধান মেলে তাদের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন হিন্দু।
(সূত্র: শুক্রবার ১৯ মার্চ ২০২১ ৫ চৈত্র ২৪২৭ যুগান্তর,আজকের পত্রিকা।)
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ তালিকা প্রকাশিত হয়।
রাজাকার তালিকায় বরিশাল বিভাগের নারী রাজাকারের নাম হল:
বরিশাল নগরীর ঊষা রাণী চক্রবর্তী (সিরিয়াল- ৪৫)।
নগরীর ঝাউতলা এলাকার কনকপ্রভা মজুমদার (সিরিয়াল- ৩৭)। উজিরপুরের বিজয়া বালা দাস (সিরিয়াল-৩৫)
আভা রানি দাস ( সিরিয়াল -২৭) পারুল বালা কর্মকার (সিরিয়াল-৩৩) ও বাবুগঞ্জের দেহেরগতি এলাকার রাবেয়া বেগম( সিরিয়াল- ১৫১)
এদের মধ্যে ঊষারাণী চক্রবর্তী গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তপন কুমার চক্রবর্তীর মা ।অবশ্য রাজাকারের তালিকায় ৬৩ নম্বরে তপন চক্রবর্তীর নাম ও এসেছে বলে নিশ্চিত করেছে । তার মেয়ে বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব ডা.মনিষা চক্রবর্তী।
এ থেকে বোঝা যায় যুগে যুগে ঘষেটি বেগম ছিল ৭১- এ ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এই ৫০ কিংবা ৬২ জন ঘষেটি বেগম এখন কোথায় আছে আদৌ বেঁচে আছেন কিনা এখনো জানা যায়নি। বেঁচে থাকুক কিংবা না থাকুন এদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং শতাধিক ধিক থাকবে সব সময়ই।
লিলি কাদের ,শিক্ষার্থী কক্সবাজার সরকারি কলেজ।
ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক ,গ্রীন এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট, মহেশখালী উপজেলা শাখা।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।